শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মারক ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধ
আজিজুল কদির
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনির মধ্য দিয়ে জন্ম হলো একটি দেশ ও জাতির এবং সেই বিজয় ইতিহাসে ৩০ লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ের এক অমর বীর গাঁথা। আর সেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলার চারু শিল্পীরা এক সাথে শুধু হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেনি, স্বদেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য রংতুলি, ক্যানভাসে যুদ্ধকালীন সময়ে জন সম্মুখে শিল্পকর্ম রচনা করে জন সচেতনতা বাড়িয়ে তোলে। এর পরবর্তীতে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে দেশের আনাচে কানাচে মহান স্বাধীনতার স্বপক্ষে উজ্জীবিত হয়ে গড়ে তোলে বেশ অনেকগুলো ভাস্কর্য। তারই কিছু নিদর্শন এখানে তুলে ধরা হলোঃ
অপরাজেয় বাংলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের চত্বরে অপরাজেয় বাংলার অবস্থান। সাড়ে সতের ফুট উচ্চতার এই কংক্রিটের স্মৃতিসত্মম্ভ অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের আস্থার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের শিক্ষক সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালেদ এই ভাস্কর্যের অমর স্রষ্টা। এ ভাস্কর্যটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের একটা সার্বিক রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিকৃতিতে দাঁড়ানো তিনজন মুক্তিযোদ্ধার একজন গ্রামের যুবক। যার বাম হাতে গ্রেনেড ডান হাতে রাইফেল। অন্য প্রতিকৃতিটি রাইফেল হাতে দাঁড়ানো একজন ছাত্রের। সবশেষ মূর্তিটি একজন সেবিকার যিনি ফাষ্ট এইড কাঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেন। মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কিছু সৃষ্টির তাগিদ থেকেই শিল্পী এটা তৈরী করেছিলেন। এটা তৈরীর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ডাকসুর সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ম. হামিদ। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা এর ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করেছিলেন। ভাস্কর্যটির তৈরীর মডেল হিসেবে কাজ করেছিলেন সৈয়দ হামিদ মাকসুদ, বদরুল আলম এবং ফাল্গুনী হামিদ।
শহীদ মিনার
মহান ভাষা আন্দোলনের স্মারক শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের উত্তর-পশ্চিম পাশে ভাষা শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। বাংলাদেশে যত স্মৃতি ভাস্কর্য আছে তার মধ্যে এই শহীদ মিনারের ওপর দিয়েই ধকল গেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর দিকগুলোতে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি যখন শুরু হয় তখনই পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনী কয়েকবার এটি ভেঙে দেয়। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে ঘাতকের বুলেটে নিহক হয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো কয়েকজন। যে স্থানে এর শহীদ হয়েছিলেন সেখানেই এটি নির্মিত হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের পরিকল্পনা, স্থান নির্বাচন ও নির্মাণের সমন্বয়ে প্রথম এটার কাজ শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ২৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এটি উদ্বোধন করার পর পরই পাকিসত্মান সরকারের পুলিশ এটি ভেঙে দেয়। ১৯৬৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন, মওলানা ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। এরপর শিল্পী হামিদুর রহমান নিজস্ব নকশা ও পরিকল্পনায় ১৯৫৭ সালে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক সরকার এই কাজ বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিসত্মানি সামরিক জান্তা পনরায় এটি ভেঙে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২-এ আবারো শহীদ মিনারের মূল নকশার সাথে সূর্যের মতো লাল বৃত্ত সংযোগ করেন শিল্পী মুসত্মাফা মনোয়ার। ১৯৮৩ সালে নির্মিত চত্বরটিই বর্তমানের রূপ নিয়ে টিকে আছে। এখানেই ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের স্মরণে পুপার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। দাবি আদায়, প্রতিবাদ সংগ্রামে শহীদ মিনার চত্বর হয়ে উঠেছে মূল কেন্দ্র। চট্টগ্রামে নগরীর মুসলিম হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার ।
জয় বাংলা, জয় তারুণ্য
টিএসসি ও শামসুন্নাহার হলের মাঝামাঝিতে জয় বাংলা, জয় তারুণ্য ভাস্কর্যটির অবস্থান। ১৯৯৩ সালে শহীদ মিজানের মা এটি উন্মোচন করেন। এতে কোনো একজন নয় বরং স্বাধীনতা উত্তরকালে শহীদদের স্মৃতির প্রতি এই ভাস্কর্যটি উৎসর্গ করা হয়েছে। আলাউদ্দিন বুলবুলের তৈরি এই ভাস্কর্যটি তৈরি হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উদ্যোগে।
শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত সত্মম্ভ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ভাস্কর্যের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে দুটি আছে শহীদদের প্রতি উৎসর্গকৃত। এর একটি ২৫ মার্ছ কালরাতে একাত্তরে শহীদ হরের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীদের উদ্দেশে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রয়েছে মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্য, শহীদ মৃণাল বোস ফোয়ারা, শহীদ আসাদ আহমেদ মুন্না স্মৃতিসত্মম্ভ, ক্যাডেট রুমী ভাস্কর্য ইত্যাদি।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে টিএসসির সামনে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটির অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ, বিপ্লব, আত্মসমর্পণ, নারী নির্যাতন, যুব ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকে স্মরণ করে ভাস্কর শামীম শিকদার স্বোপার্জিত স্বাধীনতা তৈরি করেন। বিভিন্ প্রতীকী চিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে লেখা আছে বিভিন্ন ধরণের উক্তি। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই ইত্যাদি।
স্বাধীনতা সংগ্রাম
উদয়ন স্কুল ও সলিমূল্লাহ হলের মাঝে অবস্থিত এই বিশাল স্থাপত্য শিল্পটি বাংলার কৃতি সনত্মানদের প্রতিকৃতির সমন্বয়ে গঠিত। সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতিটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আদলে তৈরী। এছাড়া কবি সুকানত্ম, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, মহাত্মা গান্ধীসহ গ্রাম বাংলার নানা পেশার মানুষের প্রতিকৃতি রয়েছে এখানে। এই ভাস্কর্যটি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করেছেন শিল্পী শামীম শিকদার। এর ব্যয়ভারও তিনি বহন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
পুরান ঢাকায় অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রবেশপথে মুক্তিযুদ্ধের প্রসত্মুতি শীর্ষক ভাস্কর্যটির অবস্থান সিমেন্টের তৈরি বিশাল আকৃতির দুটো ভাস্কর্য তৈরি করেন শিল্পী রাশা। এতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির বিভিন্ন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ
মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের মোজাইক ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে ঢাকার বিজয় সারণিতে। শিল্পী সৈয়দ লুৎফুল হকের তৈরি এই ম্যুরালগুলোতে শহীদ মতিউর রহমান, শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, শহীদ আব্দুর রউফ, শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখ, শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমীন, শহীদ মোসত্মফা কামাল, শহীদ হামিদুর রহমানের অবিকল চিত্র ফুটিয়ে তোল হয়েছে।
মুক্তি চাই, স্বাধীনতা চাই
ঢাকার বিজয় সারণিতে মোজাইকের তৈরি ম্যুরাল ‘মুক্তি চাই স্বাধীনতা চাই’ ভাস্কর্যটির অবস্থান। এতে প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার হাতে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলকে মোজাইকের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এটি তৈরি করেছেন সৈয়দ লুৎফুল হক।
একাত্তরের গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ভাস্কর রাশা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিশাল স্মারক ভাস্কর্যের অবস্থান।
ভাস্কর্য
ঊনসত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনের বীর সৈনিক শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে নির্মিত ভাস্কর্য নামের শিল্প কর্মটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অবস্থিত। এর ভাস্কর প্রদ্যুত।
শিখা চিরন্তন
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। একই জায়গায়’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিখা চিরনত্মন স্থাপন করা হয়। কিন্তু এর নির্মাণ কাজ আজও শেষ হয়নি।
বিজয়
রামপুরায় অবস্থিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের সামনে বিজয় ভাস্কর্যটি। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা যেটি কাঠ খোদাই করে তৈরি। এটি তৈরি করেছেন ৪ জন দেশবরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী, সৈয়দ লুৎফুল হক, রেজাউন নবী ও আব্দুস সাত্তার। লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই ধাতব তৈরি ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। শাহবাগের বাংলা একাডেমী চত্বরে এটির অবস্থান। লুঙ্গিপরা একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে একটি রাইফেল বীরত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে তুলে ধরা।
মৌচাক সড়কদ্বীপের স্মৃতিসৌধ
ঢাকার রামপুরা মৌচাক সড়কদ্বীপে মুক্তিযুদ্ধে নিহত দুজন শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় হরতাল ও টিভি ভবন ঘেরাও কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র ফারুক ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা শহীদ তসলিমও ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর শহীদ হন। এখানেই দুজনকে সমাহিত করা হয়েছে।
স্মারক ভাস্কর্য
কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের সামনে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন একটি স্মারক ভাস্কর্য রয়েছে। এতে বিভিন্ন বিষয় প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ফোয়ারা
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাত বীরশ্রেষ্ঠদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ফোয়ারা। গুলিসত্মান এলাকায় অবস্থিত সাতটি পাতা ও ফুলের পাপড়ি সমৃদ্ধ এই ভাস্কর্যটিতে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। এটি নির্মাণ করেন স্থপতি সিরাজুল ইসলাম।
লা-গোয়ের্নিকা বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাঙ্গণে অবস্থিত ভাস্কর্যটির ভাস্কর শামীম শিকদার। সিমেন্টের তৈরি প্রতীকী চিত্র সংবলিত এই ভাস্কর্যটি।
শিখা অনির্বাণ
ঢাকা ক্যান্টমেন্ট এলাকায় অবস্থিত শিখা অনির্বাণ। এখানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মরণে নির্মিত এই ভাস্কর্যটিতে সারাক্ষণই আগুনের শিখা প্রজ্বলিত হয়। চিরদিন এ শিখা জ্বলবে- এ উদ্দেশ্যে নির্মিত শিখা অনির্বাণ বাঙালিদের একটি গৌরবের বিজয় সত্মম্ভও বটে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যারা
ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনের মধ্যে অবস্থিত বিশাল আকৃতির স্মৃতিসত্মম্ভটি দূর থেকেই চোখে পড়ে। নিচে গম্বুজ আকৃতির ভেতরে উপর এই স্মৃতিফলকটির নিচের দিকে শ্বেতপাথরের ফলকে শহীদদের দীর্ঘ নামের তালিকা রয়েছে। এতে ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে নিহত পুলিশ সদস্যদের বীরত্বগাথা ফুটে উঠেছে।
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ
ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সাভারের নবীনগরে স্বাধীনতা যুদ্ধের লাখো শহীদের ত্যাগ ও সাহসিকতার বিজয়ের প্রতীক সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ। কংক্রিট নির্মিত সাতটি সত্মম্ভের সমন্বয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। মূল সৌধ বাদে অন্যান্য স্থাপনা লাল ইটের তৈরি। সৌধের সামনে রয়েছে গণকবর ও কৃত্রিম জলাশয়। সৌধ এলাকাটির ২৪ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে মনোমুগ্ধকর সবুজ বনানী ও লেক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে এটি উদ্বোধন করেন। দেশের রাষ্ট্রীয় দিনগুলোতে এখানে শহীদদের স্মরণে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ
২৫ মার্চের পর থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যনত্ম পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে মিরপুর এক নম্বর মাজার রোডে নির্মাণ করা হয়েছৈ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। মূল স্মৃতিসৌধটি লাল ইটের চারটি বেদি নিয়ে নির্মিত। বেদির সামনে একটি খাড়া সত্মম্ভে খোদাই করা আছে এর উদ্বোধনের তারিখ। রয়েছে কৃত্রিম জলাশয়, সৌধের একপাশে রয়েছৈ জাতীয় নেতা, বুদ্ধিজীবী আর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কবর। স্মৃতিফলক চমৎকার একটি বাণী উৎকীর্ণ রয়েছে।
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ
নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়ানো পাকিসত্মানি সামরিক জানত্মা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর, আলসামস এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যায় মেতে ওঠে। দেশকে মেধাশূন্য করে এসব শ্রেষ্ঠ সনত্মানদের লাশ ফেলে রাখে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। তাদের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। অসংখ্য লাল ইটের সমন্বয়ে তৈরি এই সৌধ আমাদের বেদনার্ত স্মৃতি জাগানিয়া স্মৃতিফলক। সৌধের মাঝে আয়তাকার জানালার মতো একটি অংশ রয়েছে। সামনে থেকে দেখলে লাল ইটের মাঝে চোখে পড়বে একটুকরো আকাশ। সৌধের সামনে কৃত্রিম লেক। ওপারে কালো পাথরের তৈরি একটি সত্মম্ভ। বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন।
স্মৃতিসত্মম্ভ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ইনডিপেডেন্টস স্কয়ারে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছাত্র-শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নামফলকসহ নির্মিত স্মৃতিসৌধ একাত্তরের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে পোড়া মাটির ফলকে চোখ বাঁধা, হাতমুখ বাঁধা ও যুদ্ধরত বীর বাঙালির যুদ্ধের পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে।
জাগ্রত চৌরঙ্গী
১৯৭১ সালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাসত্মায় জাগ্রত চৌরঙ্গী ভাস্কর্যটির অবস্থান। হাতে গ্রেনেড ও রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধা স্মারক ভাস্কর্যটি সিমেন্টের তৈরি। স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ নং সেক্টরে ১৬তম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের শহীদ সৈনিকদের স্মরণে এটি নির্মিত ভাস্কর্য শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক এটি নির্মাণ করেন। এছাড়া গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ি ও টঙ্গীতেও দুটি স্মৃতি ভাস্কর্য রয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভ
ঢাকার কচুক্ষেত বাজারে স্বাধীনতা চত্বরের পাশে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসত্মম্ভটি অত্যন্ত অবহেলা ও অযত্নে রয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জে. মোহাম্মদ মোসত্মাফিজুর রহমান এটি উদ্বোধন করেন। এটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
শহীদ মিনার, নারায়ণগঞ্জ
এক সময়ের এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিলস্ এর স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিপাগল হাজার হাজার শ্রমিকের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন সেসব সাহসী, ত্যাগী আত্মবিসর্জনকারীদের উদ্দেশ্যে আদমজী নগর শ্রমিক কলোনিতে নির্মিত হয়েছে এই শহীদ মিনার। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় বঙ্গবন্ধু সড়ক মোহনায় আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সত্মম্ভ রয়েছে।
সংশপ্তক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বারক ভাস্কর্য সংশপ্তক এর অবস্থান। স্বাধীনতার গৌরবদীপ্ত চেতনাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করেছেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। ভাস্কর্যে যুদ্ধে লোকটির একটি হাত গেছে, সেই সঙ্গে ছিন্ন হয়েছে দুটি পা, তবু তার বিজয়ের প্রত্যাশা। প্রাণপণে লড়ে যচ্ছে সে রাইফেল নিয়ে।
গণকবর, চট্টগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ইতিহাস স্বমহিমায় সমুজ্বল। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ অসংখ্য সৈনিকদের গণকবর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত নাম সংবলিত স্মৃতিফলক। উপরে বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত এই ফলকের গায়ে অসংখ্য সৈনিকের নাম খোদাই করে লেখা রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যটি তৈরি করেন শিল্পী মুর্তাজা বশির। চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে রয়েছে পুলিশ কর্মচারীদের তালিকার নামফলক, বিডিআরদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতি অম্লান, রেলওয়ের যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণে ফয়েজ লেক এর পাড়ে নির্মিত শহীদ স্মরণে ১৯৭১ স্মৃতিসত্মম্ভ, ষোল শহরে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি স্মৃতি সত্মম্ভ এবং চট্টগ্রাম নগরীর বিপ্লব উদ্যানে প্রতিষ্ঠিত বাংলার বিজয় শীর্ষক ভাস্কর্য। নগরীর খুলশী এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমির উপর নির্মিত একটি স্মারক ভাস্কর্য। তবে এটি সম্পূর্ণ নয় বলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের দাবী। কারণ এই স্থানে অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার লাশের চিহ্ন। চট্টগ্রাম দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় একটি স্মৃতিসত্মম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। হালিশহরের নাথ পাড়ায় রয়েছে একটি স্মৃতিসত্মম্ভ যা নির্মান করেছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিট্রাস্ট। এছাড়া রয়েছে নগরীর লালখান বাজাওে একটি স্মৃতিসত্মম্ভ দেখা যায়।
দুর্জয় ভৈরব
ঢাকা-সিলেট, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক মোহনায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কিশোরগঞ্জে নির্মিত হয়েছে দূর্জয় ভৈরব। লাল ইটের উপর চমৎকার এই ভাস্কর্যটি অনেকটা অযত্নে অবহেলায় রয়েছে। এছাড়া আশুগঞ্জ জিয়া সার কারখানার প্রধান ফটকের সামনে শহীদদের স্মরণে স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। রাইফেল হাতে ধরা সিমেন্টের তৈরী এই ভাস্কর্যটি তৈরি করেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান।
স্মৃতিসৌধ, সিলেট
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের এমসি কলেজে স্থাপিত আর্মি ক্যাম্পে শত শত নিরাপরাধ বাঙালিকে পাক সেনারা ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। কলেজের পেছনে এসব লাশ বিরাট গর্ত করে পুঁতে রাখে বর্বর পাকবাহিনী। এসব মানুষের স্মৃতি রক্ষার্থে সিলেট সরকারি কলেজের প্রাঙ্গণে গড়ে তোলা হয়েছে শহীদ স্মৃতিসৌধ। এছাড়া তামাবিল সড়কের পাশে হাশিম মার্কেটে, জৈনত্মাপুর থানার কোয়াইঘর চিকনাগুল বাগানেও রয়েছে অন্য দুটি স্মৃতিসৌধ।
স্মৃতিসৌধ, হবিগঞ্জ
হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে অসংখ্য শহীদদের স্মরণে গড়ে তোল হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে এটি নির্মিত হয়। এটি উদ্বোধন করেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ।
শহীদ স্মরণে, সুনামগঞ্জ
১৯৭১ সালের ৩১ আগষ্ট। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার শ্রীরামসী গ্রামের শতাধিক স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে মিটিংয়ের অজুহাতে ডেকে আনা হয়। মিথ্যে মিটিংয়ের নামে ডেকে এনে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় নিরীহ গ্রামবাসীদের। পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী এ দেশের দালাল রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহায়তায় এদের হত্যা করা হয়। পরে বাজার সংলগ্ন স্কুল প্রাঙ্গণেই গর্ত করে এদের গণকবর দেয়া হয়। এই হৃদয়বিদারক স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদদের নামের তালিকাসহ নির্মিত হয়েছে শহীদ স্মরণে নামে এই স্মৃতিসত্মম্ভটি।
শহীদ সাগর, নাটোর
১৯৭১ সালের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিসত্মানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর পান্ডারা মিলে নাটোর থানার লালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের কর্মকর্তা কর্মচারী ও আশপাশের নিরস্ত্র মানুষদের ধরে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সাগর। এখানেই নির্মিত হয়েছে নর্থবেঙ্গল সুগার মিল শহীদ স্মৃতিসত্মম্ভ।
সাবাস বাংলাদেশ
একাত্তরে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য সাবাস বাংলাদেশ গড়ে তোল হয়েছে। সিমেন্টের এই ভাস্কর্যটি তৈরি করেন সদ্য প্রয়াত শিল্পী নিতুন কুণ্ডু। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদদের স্মৃতি সংবলিত নামফলক ও স্মৃতিসৌধ রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে রাজশাহী বিভাগের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক সংবলিত আরেকটি শহীদ মিনার রয়েছে।
স্মৃতি অম্লান, রাজশাহী
রাজশাহী শহরের ভদ্রার মোড়ে অনেক উচ্চতায় লাল ইটের তৈরী ৩০টি ছিদ্র বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধটির অবস্থান। এছাড়া রাজশাহী কোর্ট প্রাঙ্গণেও শহীদদের স্মরণে নামফলক সংবলিত আরেকটি স্মৃতি ভাস্কর্য রয়েছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের সমাধি, যশোর
যশোর ক্যান্টনমেন্ট একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের সমাধিক্ষেত্রটি নির্মিত। যুদ্ধ চলাকালে আটক বহু মুক্তিযোদ্ধাদের এই স্থানে এনে গুলিতে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। এই গণকবরের ওপরে সমাধিটি নির্মিত।
শহীদ মিনার, টাঙ্গাইল
বর্বর পাকসেনারা স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ মানুষকে ধরে এনে বংশাই নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিত। এসব শহীদদের স্মরণে’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারটি নির্মিত।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার কেল্লাপাথর গ্রামে এই কবরস্থানটি অবস্থিত। স্বাধীনতা সংগ্রামে ৪৯ জন বীর সনত্মানকে এখানে সমাহিত করা হয়।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মেহেরপুর
মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নাম বদলে এখানকার নাম মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে’৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। মুজিবনগরেই ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধটি নির্মিত।
গল্লামারী স্মৃতিসৌধ, খুলনা
খুলনা শহরের গল্লামারী নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধের সময় শত শত নিরাপরাধ মানুষকে পাক আর্মি ও রাজাকারেরা নির্মমভাবে হত্যা করে। গর্ত করে সব লাশ পুঁতে ফেলা হতো এই বধ্যভূমিতে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে গল্লামারী স্মৃতিসৌধ।
No comments:
Post a Comment