Thursday, February 18, 2010



আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ও একজন আবদুল গাফফার চৌধুরী



০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৮:০১



১৯৫২ সাল, পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনমুখর। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মিছিলে গুলিবর্ষণ হলো। ভাষার জন্য জীবন দিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে ভাষা শহীদদের লাশ দেখার জন্য ছাত্র-জনতার ভিড় জমে গেল। শহীদ বরকতের লাশ দেখে সেদিন ঢাকা কলেজের এক ছাত্রের ভাবার হলো অন্যরকম। তার মনে হলো, বরকত তো অন্য কেউ নন, তিনি যেন তারই ভাই। মনে জেগে উঠল কবিতার লাইন 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।' এভাবেই লেখা হয়ে গেল একটি দীর্ঘ কবিতা। সেদিনের কলেজ পড়ুয়া মাত্র আঠারো বছর বয়সী ওই তরুণের নাম আবদুল গাফফার চৌধুরী।
তার সেই দীর্ঘ কবিতাটিতে প্রথমে সুর দেন আবদুল লতিফ। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে ওই কবিতাটি প্রভাত ফেরির গান হিসেবে অমর একুশের ব্যাঞ্জনা নিয়ে আসে। যতদিন একুশে ফেব্রুয়ারি থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবে ওই গান- আর বাঙালি জাতি স্মরণ করবে একজন আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার উলানিয়া গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্ম জহুরা খাতুন। গাফফার চৌধুরীরা তিন ভাই, পাঁচ বোন। বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম।
এক সাক্ষাকারে গাফফার চৌধুরী বলেন, 'আমাদের পরিবারটা ছিল জমিদার পরিবার। সবাই বলত, উলানিয়ার জমিদার বংশ। তখন বরিশালে মুসলিম জমিদার তেমন ছিল না বললেই চলে। শায়েস্তাবাদের নবাব বংশও ছিল আর একটি দুর্লভ মুসলিম জমিদার বংশ। পারিবারিকভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত ডক্টর কামাল হোসেন। উলানিয়ায় আমাদের পারিবারিক জমিদারিটা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক জমিদারি। এটি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ট্যাগোর এস্টেটের অংশ ছিল। ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সঙ্গে তাদের ভূ-স্বামীত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।' তবে এর অবয় শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। উলানিয়া গ্রামটি ছিল বেশ সঙ্ন্ন ও সমৃদ্ধ। সেখানে ছিল একটি জুনিয়র মাদ্রাসা, একটি ইংলিশ হাইস্কুল, সুন্দর একটি জামে মসজিদ ও একটি ঈদগাহ। মুসলিম প্রধান এলাকা হলেও স্কুলে আরবি শিক ছাড়া অন্য সব শিকই ছিলেন হিন্দু। হেডমাস্টার প্রতাপ চন্দ্র গুহ ছিলেন এমএসসি, বিএল। অন্য শিকদের সবাই ছিলেন গ্রাজুয়েট।



শিক্ষা জীবন
আবদুল গাফফার চৌধুরীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় মাদ্রাসায়। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় কাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে তিনি হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এই হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাশ করেন। গাফফার চৌধুরী তার শিক্ষা জীবন সর্কে বলেন, 'মাদ্রাসায় আমার শিক্ষা জীবন শুরু হলেও সেখানে বাংলা ও ইংরেজিও পড়ানো হতো। সেখানকার পরিবেশটা ছিল অনেক খোলামেলা।' ১৯৪৬ সালে পিতার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সে সময় আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস নেতা দুর্গামোহন সেন সাদিত 'কংগ্রেস হিতৈষী' পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। কিছুদিন বরিশাল শহরে মার্কসবাদী দল আরএসপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো। তিনি গাফফার চৌধুরীকে লেখালেখিতে উসাহিত করতেন। তাদের মধ্যে প্রায়ই সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা চলত।
কর্মজীবন
১৯৪৭ সাল থেকে স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করলেও ১৯৫০ সালেই গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি 'দৈনিক ইনসাফ' পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন বেতন পেতেন ৭০ টাকা। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন 'দৈনিক ইনসাফ' পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে 'দৈনিক সংবাদ' প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে মাসিক বেতন পেতেন ১শ' টাকা। তারপর বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের মাসিক 'সওগাত' পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। এ সময় তিনি 'মাসিক নকীব'ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সাদিত 'দিলরুবা' পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক 'ইত্তেফাক'র সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা 'মেঘনা'র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক 'ইত্তেফাক'র সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা 'চাবুক' সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন জারি হলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর মাওলানা আকরম খাঁ'র দৈনিক 'আজাদ'-এ সহকারী সস্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময় তিনি মাসিক 'মোহাম্মদী'রও স্বল্পকালীন সস্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে দৈনিক 'জেহাদ'-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক 'সোনার বাংলা'র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসায় নামেন এবং 'অনুপম মুদ্রণ' নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দু'বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে দৈনিক 'আওয়াজ' বের করেন। বছর দু'য়েক চলেছিল পত্রিকাটি। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি দৈনিক 'আজাদ'-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি পুনরায় যোগ দেন দৈনিক 'ইত্তেফাক'-এ। ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ইত্তেফাক সাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্টে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক 'পূর্বদেশ'-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'য় লেখালেখি করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় দৈনিক 'আনন্দবাজার' 'যুগান্তর' পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক 'জনপদ' বের করেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পরবত্তীতে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তারপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। তারপর ১৯৭৬ সালে 'বাংলার ডাক' নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা সাম্পদনা করেন। 'সাপ্তাহিক জাগরণ' পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে সাতজন অংশীদার নিয়ে 'নতুন দিন' পত্রিকা বের করেন। তারপর ১৯৯০ সালে 'নতুন দেশ' এবং ১৯৯১ সালে 'পূর্বদেশ' বের করেন। প্রবাসে বসে এখনও গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।
পারিবারিক জীবন
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেলিমা আফরোজকে বিয়ে করেন। তার একমাত্র ছেলে অনুপম আহমেদ রেজা চৌধুরী। চার মেয়ে তনিমা, চিন্ময়ী, বিনীতা ও ইন্দিরা।
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমী পদক, একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদকসহ বাংলাদেশের প্রধান পুরস্কারের প্রায় সব ক'টিই পেয়েছেন। সাংবাদিকতায় যেমন তার অবদান আছে, তেমনি একজন সুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশ-বিদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে, সম্মাননা দিয়েছে।
ক্ষেতত্তিক অবদান
পেশায় সাংবাদিক হলেও আবদুল গাফফার চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে সবসময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছেন। এছাড়া সাহিত্যকর্মী হিসেবে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাজ করেছেন সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়। তরুণ বয়সে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' তখনই লেখা। এছাড়া গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাস ও রাজনৈতিক প্রবন্ধও লিখেছেন প্রচুর। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 'চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান', 'সম্রাটের ছবি', 'ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা', 'বাঙালি না বাংলাদেশী' প্রভৃতি। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ত্রিশটি।
এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে আছে 'পলাশী থেকে বাংলাদেশ', 'একজন তাহমিনা' 'রক্তাক্ত আগস্ট'। ডকুড্রামা পলাশী থেকে বাংলাদেশ তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। প্রবাসে বাস করলেও আবদুল গাফফার চৌধুরী বাঙালি জাতির অন্তত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন।


একুশে ফেব্রুয়ারি ২০১০



আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস


"একুশে ফেব্রুয়ারি" এখানে পুনর্নির্দেশ করে। অন্য ব্যবহার-এর জন্য দেখুন একুশে ফেব্রুয়ারি''' (দ্ব্যর্থতা নিরসন).




বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে অবস্থিত শহীদ মিনার,১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মৃতিতে


একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগনের গৌরবজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত।এটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।[১]


[সম্পাদনা] ইতিহাস


বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে।


ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্রযুবা হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।


তখন থেকে প্রতি বছর এ দিনটি জাতীয় শোক দিবসহিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। এ সময় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারিগানের করুণ সুর বাজতে থাকে।


বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়। এদিন শহীদ দিবসের তাপর্য তুলে ধরে রেডিও, টেলিভিশন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশের সংবাদপত্রগুলিও বিশেষ ত্রেড়পত্র প্রকাশ করে।


১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে।